১৩ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার, সকাল ৮:০০



আজ : ১৩ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা : ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৫

  • কোন মন্তব্য নেই

    ডেভিল হান্টে বিপ্লবের গ্রেফতার চায় নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা, হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ

    বিপ্লব সরকার, ছবি- ইন্টারনেট থেকে।

    মনিরুল ইসলাম, ঢাকা :

    জাল সনদ, নকল বই এবং চাঁদাবাজি করে বিপ্লব সরকার হাতিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। চাঁদা না দিলে বিপ্লব সরকার ও তার সিন্ডিকেটের হাতে নিগ্রহ হতে হয়েছে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত ও সাইন্সল্যাবের অনেক ব্যবসায়ীকে। কাউকে ডেকে নিয়ে হুমকি আর কাউকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে ভয়ের রাজত্ব কায়েম রেখেছিলেন
    ১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ বিপ্লব সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন টার্মের পুরোটা সময় বিপ্লব একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিউমার্কেট ও তার আশেপাশের সবকিছু।

    এবার তার অপকর্ম ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন নিউমার্কেটের ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা। নিউমার্কেট এলাকার বই ব্যবসায়ী নুরে আলম চলমান ডেভিল হান্ট অপারেশনে নিউমার্কেট এলাকার এ ডেভিলকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন।

    জানা যায়, ভাগ্য অন্বেষণে প্রায় দুই যুগ আগে মামার হাত ধরে নিউমার্কেট আসেন বিপ্লব সরকার, কাজও জুটে যায় ফটোকপির দোকানে। প্রথম পৃথিবীখ্যাত বই, জার্নাল প্রিন্ট করে বিক্রি করতে শুরু করেন।

    মাত্র একবছরের মাথায় নিউমার্কেট নীলক্ষেতের জাল সনদ তৈরির সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত হন বিপ্লব। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, জাল সনদের টাকার প্রভাবে সক্রিয় হন রাজনীতিতে, বাগিয়ে নেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পদ। তারপর সব সিন্ডিকেট বাদ দিয়ে নিজের নামেই শুরু করেন জাল সনদ সিন্ডিকেট যা ‘বিপ্লব সিন্ডিকেট’ নামে বহুল পরিচিত।

    তখন সজল, মাহবুব ও আলমগীরের মত অস্ত্রধারীরাও যুক্ত হন এ সিন্ডিকেটে।

    জাল সনদ, নকল বই এবং নিউমার্কেট নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি করে হাজার কোটি টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছে এ বিপ্লব সরকার ও তাঁর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে. অর্থ পাচার করে দুবাইয়ে হোটেল এবং ভারতে বাড়ি করেছেন, নিউমার্কেটে ৭টি দোকান করেছেন বলেও অভিযোগ উঠছে তাঁর বিরুদ্ধে।

    হাসিনা পতনের পর বিল্পবের সব দোকান বন্ধ থাকলেও সাম্প্রতিক বিএনপির এক নেতার আশীর্বাদে তা আবার খুলেছে।

    সূত্র মতে, ২০১২ সাল থেকে জাল সনদ ও নকল বইয়ের পাশাপাশি বিপ্লবের হাতে চলে আসে নিউমার্কেট ও সায়েন্সল্যাবের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণের সুযোগ।

    রাজধানীর নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, সায়েন্সল্যাব ও এলিফ্যান্ট রোড এলাকা ঘিরে ফুটপাত ও সড়কে ১২শ থেকে ১৩শ দোকান রয়েছে। এছাড়া রাস্তার ডিভাইডার ও বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আরও ২০০ দোকান করেছিলেন বিপ্লব সরকার। মোট ১৫০০ দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলত এ সিন্ডিকেট। এছাড়া দোকান নিয়ে বসার জন্য এককালীন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হতো বিপ্লবকে।

    হকারদের তথ্য মতে, ১৫শ দোকান থেকে গড়ে ৬০০ টাকা করে চাঁদা উঠলেও মাসে প্রায় তিন কোটি টাকা, আর ঈদে এই চাঁদার পরিমাণ বেড়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা হয়ে যায়। ৬০০ টাকার মধ্যে পুলিশ নিত ১০০ টাকা, লাইনম্যান দেওয়া হত ৫০ টাকা, স্থানীয় নেতারা পায় ১০০ টাকা এবং ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা পায় ১০০ টাকা করে। চাঁদার টাকা তুলতে পেশাদার লাইনম্যানও নিয়োগ করেছিলেন বিপ্লব সরকার।

    সূত্র মতে, সায়েন্সল্যাবের বায়তুল মামুর মসজিদ মার্কেটের সামনে থেকে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের ফুটপাত পর্যন্ত একটি লাইন। এভাবে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার থেকে কাদের আর্কেড শেরওয়ানি মার্কেট হয়ে ওরিয়েন্টাল লাটিমী শপিংমল পর্যন্ত একটি। লাটিমী মল থেকে জাহান ম্যানশন শপিংমল, গোল্ডেন গেন শপিং সেন্টার, মাহমুদ ম্যানশন ও পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত একটি লাইন।

    এছাড়া গ্লোব শপিং সেন্টার থেকে বদরুদ্দোজা সুপার মার্কেট, নেহার ভবন শপিং সেন্টার, নূরজাহান সুপার মার্কেট পর্যন্ত একটি লাইন রয়েছে। নূরজাহান থেকে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ফুটপাত পর্যন্ত আরেকটি লাইন। ধানমন্ডি হকার্সের দক্ষিণ পাশের শুরু থেকে নূরানী মার্কেট, মিনি মার্কেট, এয়াকুব সুপার মার্কেট, কাজী ম্যানশন, শাহানুর ম্যানশন, রিজেন্সি প্লাজা হয়ে ইস্টার্ন মল্লিকা পর্যন্ত একটি লাইন।

    ইস্টার্ন মল্লিকার উলটো পাশ থেকে নিউমার্কেটের দিকে আসতে গ্রিন সরণিকা, সুবাস্তু এ্যারোমা সেন্টার শপিংমল, ইসমাইল ম্যানশন, গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানশন, চাঁদনি চক মার্কেট পর্যন্ত একটি লাইন। চাঁদনি চক থেকে বলাকা সিনেমা হল পর্যন্ত একটি, বলাকা থেকে নীলক্ষেত হয়ে নিউমার্কেট থানার আগ পর্যন্ত একটি লাইন ছিল।

    নীলক্ষেত মোড় থেকে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট পর্যন্ত একটি, চন্দ্রিমা থেকে ঢাকা কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হয়ে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত একটি এবং চন্দ্রিমা থেকে বিশ্বাস বিল্ডার্স হয়ে শাহনেওয়াজ হল পর্যন্ত আরেকটি লাইন রয়েছে।

    এছাড়া কাঁচাবাজারের জন্য তাদের আলাদা চাঁদার ফর্দও রয়েছে।

    একেকটি ফুটপাতের লাইন নিয়ন্ত্রক হিসেবে ছিলেন, সাত্তার মোল্লা, বিপ্লব সরকারের নিজের ফুফাতো ভাই শাহীন, সেলিম আমিনুল, মামুনসহ আরো বেশ কয়েকজন।

    নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউমার্কেটের একজন ব্যবসায়ী বলেন, বিল্পব সরকারের সাথে এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রক হিসাবে আলোচিত নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের ১৮নং ওয়ার্ডের সাবেক নেতা ইব্রাহিম হোসেন ইবুও। মূলত তারাই এ সিন্ডিকেটের হর্তাকর্তা ছিলেন, ফুটপাতের ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাঁরা। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্যেও চাঁদাবাজদের তালিকায় তার নাম রয়েছে। ১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব সরকার এবং লিটন ফুটপাত নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হোতা ছিলেন। তাদের ইশারাতেই চলেছে ফুটপাতের সব কার্যক্রম। তাছাড়া নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটের সব নকল জাল সার্টিফিকেট বিল্পব ও তার লোকজনই করত। এদের প্রত্যেকে একসময় সামান্য আয়ের মানুষ ছিল। ফুটপাতের কল্যাণে এখন তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং আলিশান জীবন-যাপন। এছাড়া ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় নেতা সাত্তার মোল্লা, উজ্জ্বল, ছৈয়া, মামুন, বিল্লাল, বাচ্চু, রাহাত, ইসমাইল, আকবর, আমিনুল, সেলিম ও শাহিন ছিল হাসিনার আমলে।

    নিউমার্কেটের এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, চাঁদা যা আসুক ইবু প্রতি মাসের শুরুতে ১ কোটি টাকা ক্যাশ দিতেন বিপ্লব সরকারকে। ইবু মাদকের সাথেও জড়িত ছিলেন যদিও এর পুরো মদদই দিয়েছে বিপ্লব। কি ছিল এই বিপ্লব? মাদক ও সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে বই মার্কেটে,পাইরেসি ব্যবসা এবং ফুটপাতের চাঁদাবাজি করে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। দুবাইয়ে রেষ্টুরেন্ট খুলেছেন ‘হাজী মোহাম্মদ বিপ্লব সরকার’ । বউ ও শ্বশুরের নামে কিনেছেন ফরিদপুরে কয়েকশো কোটি টাকার জায়গা সম্পত্তি। এক সময় বলাকা সিনেমা হলের সামনে টিকিট বিক্রি ও ফুটপাতে দোকানদারি করা বিপ্লব আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বদলে ফেলেন তার জীবনযাত্রা। হয়েছেন প্রায় কয়েকশো কোটি টাকার মালিক।

    তিনি আরও বলেন, বিল্পবের গাড়ি কতগুলো, কি ভাবে আসল এত টাকা, কত টাকা খরচ করেন তিনি কোরবানির গরু কিনতেন। এসব খোঁজ খবর করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।

    অভিযোগের বিষয়ে বিপ্লব সরকারের বক্তব্য নিতে তাকে ফোন করে ও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।