সমকালের প্রতিবেদনে সরকারি গাড়ি ব্যবহারে উপদেষ্টাদের অনিয়মের চিত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক । নিউজনেক্সটবিডি.কম
সরকারি গাড়ি ব্যবহারে উপদেষ্টাদের অনিয়ম নিয়ে একটি প্রতিবেদক প্রকাশ করেছে দৈনিক সমকাল। অনলাইন ভার্সনে পোস্ট করার অল্প সময়ের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবেদনটি বেশ আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয়।
সমকালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের ২২ উপদেষ্টার মধ্যে আটজন ছাড়া বাকি সবাই একাধিক সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। একমাত্র বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সরকারি কোনো গাড়িতেই চড়েন না। সরকারি কাজে তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরই সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর (পরিবহন পুল) থেকে একটি করে টয়োটা হাইব্রিড ক্যামরি গাড়ি বরাদ্দ পান সব উপদেষ্টা। দৈনিক ১৮ লিটার জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ টাকাও পাচ্ছেন তারা। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কয়েকজন উপদেষ্টার পরিবারের সদস্য ব্যবহার করছেন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রকল্পের দামি গাড়ি। এ জন্য বিভিন্ন দপ্তর থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে একাধিক চালকও। এসব বাড়তি গাড়ির পেছনে চালক, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ গাড়িপ্রতি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রতি মাসে গচ্চা যাচ্ছে প্রায় লাখ টাকা।
১৯৭৩ সালের ‘দি মিনিস্টারস, মিনিস্টারস অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টারস (রেমিউনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস)’ অ্যাক্টে স্পষ্ট বলা আছে, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা (বর্তমান উপদেষ্টারা মন্ত্রী মর্যাদার) সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য সরকারি একটি কার (গাড়ি) পাবেন। যার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ জোগাবে সরকার। পরে সংশোধিত আইনে বলা হয়, জরুরি দাপ্তরিক কাজের জন্য কিংবা ঢাকার বাইরে নির্ধারিত কোনো সফরে গেলে অতিরিক্ত একটি জিপগাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দপ্তর কিংবা সংস্থাকে জিপগাড়ি সরবরাহ করতে হবে। অথচ উপদেষ্টারা একাধিক গাড়ি কবজায় নিয়ে ইচ্ছামতো জ্বালানিতে অপ্রয়োজনে বা ব্যক্তিগত কাজে ঘুরছেন। এ সুযোগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাড়িচালকরাও জ্বালানি কেনার পরিমাণ বেশি দেখিয়ে বাড়তি টাকা পকেটে পুরছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কার কত গাড়ি
সরকারি গাড়ি ব্যবহারের দিক থেকে এগিয়ে আছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। প্রভাব খাটিয়ে এই উপদেষ্টা দুটি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প থেকে নিয়েছেন একটি (ঢাকা মেট্রো-গ-১৪৫২৩৩), অন্যটি সরকারি পরিবহন পুল (ঢাকা মেটো-ভ-১১১৮৩৯) থেকে নেওয়া। পরিবহন পুলের গাড়িটি বেশির ভাগ সময় উপদেষ্টার পরিবারের কাজে ব্যবহার হয়। ওই গাড়ির চালক আলমগীর বলেন, উপদেষ্টা স্যারের চালক তিনজন। দু’জন স্যারের ডিউটি করি। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের চালক টিটু সবসময় স্যারের বাসায় ডিউটি করেন।
ফারুক-ই-আজমের দপ্তরের নামে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে আরও দুটি গাড়ি। সেগুলো তাঁর পিএস ও পিআরও ব্যবহার করছেন। এই মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী পিএস লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুল গাফফারের ব্যবহারের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে একটি পাজেরো স্পোর্ট জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮৫৫৫৮) আনা হয়েছে। মন্ত্রীর তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এনায়েত হোসেনের জন্যও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো গ-১৬৩২০৯)। পিএস ও পিআরওর চালকের বেতন থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে।
এ ব্যাপারে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জিপটাই বেশি ব্যবহার করি। জ্বালানি খরচও মন্ত্রণালয় দেয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেওয়া পরিবহন পুলের গাড়িটা বাসায় থাকে। দুজন চালক আছে।’ নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের গাড়ি এভাবে ব্যবহার করা যায় কিনা– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ওইভাবে দেখিনি। মন্ত্রণালয়ের সচিব দিয়েছেন, তাই ব্যবহার করছি।’ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের গাড়ি পিএস-পিআরও ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগে থেকে যেভাবে ব্যবহার হয়ে আসছিল, সেভাবেই ব্যবহার হচ্ছে।’
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ একাই ব্যবহার করছেন তিনটি গাড়ি। এর মধ্যে পাজেরো স্পোর্ট বড় জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ- ১৪৭৪০৪), প্রাডো (ঢাকা মেট্রো ঘ- ১৮৪৭৫৭) এবং পরিবহন পুল থেকে নেওয়া টয়োটা ক্যামরি। এসব গাড়ি উপদেষ্টা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা মিলেমিশে ব্যবহার করছেন। অর্থ উপদেষ্টার পিএস ব্যবহার করেন জনতা ব্যাংকের একটি জিপ (ঢাকা মেট্রো গ-১৫৭২৮৭), সঙ্গে চালকও ফ্রি।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩৫৯১৫) ও পরিবহন পুলের ক্যামরি ব্যবহার করতেন। তাঁর পিএস ব্যবহার করতেন চালকসহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের গাড়ি। স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্ব পাওয়ার পর উপদেষ্টা সজীব (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩৯১০০) ও তাঁর পিএস (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮৫৩২৮), এপিএস (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮৫৩২৬) ব্যবহার করছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাড়ি ও চালক। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘এপিএসদের গাড়ি ব্যবহার বৈধও না, অবৈধও না। কারণ, পদবি অনুযায়ী গাড়ি ব্যবহার করা যায় না। তবে যখন উপদেষ্টার জরুরি কাজ করতে হয়, তখন এই গাড়ি ব্যবহার করি। আবার উপদেষ্টার সঙ্গে থাকলে তাঁর গাড়িতেই উঠি।’
উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ব্যবহার করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮২২৮০) ও পরিবহন পুলের একটি টয়োটা ক্যামরি গাড়ি। তাঁর পিএস ব্যবহার করছেন আরেকটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-২১৯২০৯)। এ ছাড়া খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ব্যবহার করছেন খাদ্য অধিদপ্তরের প্রকল্পের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১২৯৯২১) ও পরিবহন পুলের ক্যামরি। আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘আমি একজন উপদেষ্টা, মানে মন্ত্রী। আমি খাদ্য অধিদপ্তরের একটা জিপ ব্যবহার করছি, আর পরিবহন পুলের গাড়িটা বাসায় থাকছে।’ এতে নিয়মের ব্যত্যয় হচ্ছে কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘকাল থেকে এটা হয়ে আসছে। সচিবরাও দুইটা করে গাড়ি ব্যবহার করছেন।’
উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ ব্যবহার করছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫৯৪৯৬) এবং ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন চড়ছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো ঘ-২১০৪১১)। তাদের দু’জনের পুলের গাড়ি ব্যবহার করছেন পরিবারের সদস্যরা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ব্যবহার করছেন নম্বরহীন একটি জিপ গাড়ি। বাড়তি গাড়ির জন্য চালকের বেতন থেকে শুরু করে তেল খরচ সবই বহন করছেন উপদেষ্টা ও তাদের দপ্তরের কর্মকর্তারা।
এদিকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম শুধু পুলের একটি গাড়ি বরাদ্দ নিলেও চালক পেয়েছেন দু’জন। তারা হলেন হাবিবুর রহমান ও সুকান্ত কুমার উজ্জ্বল। চালক হাবিবুর বলেন, ‘আমরা দুইজনই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ডিউটি করি।’
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা ২২ উপদেষ্টাকেই একটি গাড়ি ও একজন চালক বরাদ্দ দিয়েছি। শুধু বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন পুলের গাড়ি নেননি।’ স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে দু’জন চালক দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিবহন পুলে চালক সংকট আছে। উপদেষ্টাদের একাধিক চালক দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
সমকালের প্রতিবেদন থেকে