২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার, বিকাল ৫:৪৪



আজ : ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার প্রকাশ করা : ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪

  • কোন মন্তব্য নেই

    এক-এগারোর সর্বনাশ! দুই-এগারোর রাহুগ্রাস!

     

    এক-এগারো ঘটেছিল ২০০৬ সালে। আর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়েছিল ২০০৮ সালে। প্রায় তিন বছরের অভিনব শাসনব্যবস্থার আতঙ্ক দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী-আমলা-কামলা থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়ের সবজি বিক্রেতাদের মধ্যেও এক-এগারোর সেই দুঃস্বপ্ন আজো টনিকের মতো কাজ করে। ফলে আওয়ামী লীগের জমানায় যদি কাউকে বলা হতো আবার এক-এগারো আসছে তবে তাদের স্বাভাবিক আহারবিহার, কাজকর্ম ইত্যাদিতে রীতিমতো কম্পন শুরু হতো। আর সেই কম্পন থামানোর জন্য সংবিধান, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যেসব বদনজির চালু করেছিল তা প্রথমত, দলটির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, পুরো জাতিকে আরেকটি এক-এগারোর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে- যাকে অনেকেই দুই-এগারো বলে টিটকারি মারার চেষ্টা করে থাকেন।

    এক-এগারো আমাদের দেশ, জাতি এবং কালের কী সর্বনাশ করেছে, তা বলার আগে এক-এগারোর প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। রাজনীতিবিদদের কলহবিবাদ, রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্যতা, আজীবন ক্ষমতায় থাকার লালসা, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার, যথেচ্ছচার, ভোগবিলাস, জুয়া-ক্যাসিনো, বিকৃত রুচিবোধের উল্লম্ফন ইত্যাদি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যক্তি ও পরিবারে ছড়িয়ে দেওয়ার যে ভ্রষ্টাচার স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল, তা ২০০৬ সালে এসে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। ফলে প্রচলিত রাজনীতিকে আমজনতা অপরাজনীতি আখ্যা দিয়ে মনেপ্রাণে একটি পরিবর্তন কামনা করেছিল। এমতাবস্থায় মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সেই বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এক-এগারো যখন এলো, তখন সাধারণ মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ল।

    এক-এগারোর প্রথম ধাক্কা এলো রাজনীতিবিদদের ওপর। দ্বিতীয় ধাক্কা এলো ব্যবসায়ীদের ওপর। প্রথম ধাক্কায় জনগণ কার্যত খুশি হয়েছিল। রাজনীতির চুনোপুঁটিদের ধরার পর যখন রাঘববোয়ালদের আটকানো হলো তখন জনগণ বলল সাধু! সাধু! সাধু! আর রাজনৈতিক দলের সাধারণ কর্মীরা প্রতিবাদ তো দূরের কথা উল্টো ওরে বাবাগো, ওরে মাগো বলে আর্তচিৎকার দিয়ে ভোঁ-দৌড়ে পুরো মাঠ মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের জন্য এমনভাবে ফাঁকা করে দিল, যা দেখে এক-এগারোর কুশীলবরা ভারি মজা পেয়ে গেল। তারা রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননের জন্য নিত্যনতুন নাটক মঞ্চস্থ করল এবং সীমার বাইরে গিয়ে জুলুম-অত্যাচার শুরু করল। ফলে সারা দেশে নজিরবিহীন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ রাজনীতির কথা ভুলে ইয়া নফ্সি! ইয়া নফ্সি! শুরু করে দিল।স্বেচ্ছাচার

    মানুষের মধ্যে পরস্পরবিরোধী দুটো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অত্যাচারী সম্প্রদায় মানুষকে ভয় দেখাতে পছন্দ করে এবং এটাকে তারা একসময় জীবনের সবচেয়ে উপভোগী বিনোদনে পরিণত করে নেয়। মানুষ হত্যা, মানুষের কান্না, রক্তপাত এবং মানুষের সঙ্গে হিংস্র প্রাণীদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে পৃথিবীর রাজাবাদশারা যে কী পাশবিক আনন্দ পেতেন, তা আমরা রোমান সাম্রাজ্যের সেই গ্ল্যাডিয়েটর উপাখ্যানের মাধ্যমে জানতে পারি। রোমান সাম্রাজ্য ছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্তে সেই অনাদিকাল থেকে আজকের দিন অবধি গ্ল্যাডিয়েটরের মতো ঘটনা স্থান-কাল-পাত্রভেদে খোলস পাল্টে যেভাবে মঞ্চস্থ হয়, তা ২০০৬-২০০৮ সালের বাংলাদেশে নিদারুণভাবে মঞ্চস্থ হচ্ছিল। ফলে ভয় প্রদর্শনকারীদের আনন্দ-ফুর্তির কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। তাদের মধ্যে কয়েকজন তো সুলতান সুলেমানের আদলে শাহি হেরেমখানা খুলে বসেছিল।

    যারা ভয় দেখায় এবং ভয় দেখানোর মাধ্যমে যে বিনোদন পায় তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জুলুমের সমাজ ও রাষ্ট্রে একধরনের মানুষ তৈরি হয়ে যায়; যারা ভয় পাওয়াকে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে মনে করতে থাকে। এটা বলা যাবে না, ওটা করা যাবে না, ওদিকে যেও না, এদিকে বসো না, ওমুকের দিকে তাকিও না, তমুকের নাম মনের মধ্যেও স্থান দিও না- এমনতর হাজারো বিধিনিষেধ একদল মানুষ নিজেদের মনমস্তিষ্কে পয়দা করে দৈনিক কয়েকবার থরথর কাঁপতে না পারলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। ফলে অত্যাচারী গোষ্ঠী ভীতু সম্প্রদায়ের ভাবসাব দেখে মনের আনন্দে অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকে।

    উল্লেখিত রসায়ন দ্বারা কামাসক্ত হয়ে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন গংরা রাজনীতিবিদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে। তারপর দিনের আলোতে একদল ব্যবসায়ীকে অত্যাচার, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হানা এবং অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমার জালে ফাঁসিয়ে পুরো অর্থনীতিতে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে। দিনের আলোতে যেমন তারা জুলুম-অত্যাচার চালাত, তদ্রƒপ রাতের আঁধারে বন্ধুত্ব ও সমঝোতার বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের ঘুষের পয়গাম নিয়ে হাসিমাখা মুখে যমদূতের আতঙ্ক নিয়ে হাজির হতো। ফলে পুরো বাংলার ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানার উৎপাদন প্রথমে থমকে যায়; তারপর উল্টো দিকে ঘুরতে থাকে।

    এক-এগারোর কুশীলবদের সীমাহীন লোভের কারণে তাদের বুদ্ধি হাঁটু থেকে ক্রমশ গোড়ালির দিকে নামতে থাকে। ফলে তারা বড় বড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করার পর দেশের জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। অবৈধ দখল-উচ্ছেদের নামে সারা দেশে যে তাণ্ডব চালায় তার ফলে দেশের অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে বুঝতে পারে কী সর্বনাশ তারা ঘটিয়ে ফেলেছে। তারপর নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য দেশিবিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা এবং নিজেদের নিরাপদ প্রস্থানের ব্যবস্থা করে। এক-এগারো আমাদের জাতীয় জীবনে মারাত্মক সর্বনাশ ঘটিয়ে দেয়। সেই জমানার কুশীলবদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। ফলে মানুষের রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষা অনুধাবন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।

    দ্বিতীয়ত, তারা কর্মজীবনে সততা-দক্ষতা এবং সফলতার মাপকাঠিতে উল্লেখযোগ্য ছিলেন না। অথচ তাদের চেয়ে বহুগুণ যোগ্যতাসম্পন্ন এবং সফল মানুষদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ফলে যোগ্যতা-অভিজ্ঞতার পরিবর্তে ভয় প্রদর্শন এবং অত্যাচারকে নিজেদের হাতিয়ার বানিয়ে তারা নিজেদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছিলেন এবং শেষ পর্যায়ে বিপুল বিক্রমে বিজয়ী হয়ে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিলেন।

    এক-এগারোর ফলে রাজনীতিবিদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়, তা এখনো চলমান। আওয়ামী জমানায় ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে মানুষের ক্রোধ ছিল। কিন্তু জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর এই ক্রোধ রীতিমতো ঘৃণা এবং বিরক্তিতে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগবিহীন বাংলাদেশে এখনো সেই এক-এগারোর প্রভাব এবং আতঙ্ক বিরাজমান, রাজনৈতিক দল সম্পর্কে মানুষের মনে নতুন কোনো ইতিবাচক ধারণা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে যেই লাউ, সেই কদু অথবা এক জালেম বিদায় হয়েছে, আরেক জালেমের আগমনের জন্য নয় ইত্যাদি প্রবাদবাক্যগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।

    দ্বিতীয়ত, এক-এগারোর সময়ে ব্যবসায়ীরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিগত দিনে অনেকেই সফল হয়েছেন। কিন্তু তারা এক-এগারোর আতঙ্ক কাটাতে পারেননি। অন্যদিকে সুযোগসন্ধানীরা অতি অল্প সময়ে বিপুল অর্থবিত্ত হাসিলের যে সুযোগ এক-এগারোর সময়ে পেয়েছিলেন, তার গল্পকাহিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বাহিনী, সব বিভাগ ও অনুবিভাগে আরব্য রজনীর গল্পের মতো মুখে মুখে প্রচার হয়ে আসছে। ফলে আরেকটি এক-এগারোর সর্বনাশ অথবা দুই-এগারোর রাহুগ্রাস ঘটানোর জন্য মন্দ লোকেরা অধীর আগ্রহ নিয়ে মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করে আসছে।

    উল্লেখিত আলোচনার প্রেক্ষপটে আমরা যদি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের হালহকিকত বিশ্লেষণ করি, তবে দেখতে পাব, এক-এগারোর চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতি ইতোমধ্য শুরু হয়ে গেছে। বিশেষত আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, মব জাস্টিস, রাষ্ট্রের আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মহলবিশেষ যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে, তা এক-এগারোর জমানায় দেখা যায়নি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, আমলাতন্ত্রের বিশৃঙ্খলা, বিচারাঙ্গনে একের পর এক নজিরবিহীন ঘটনা, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে অকার্যকারিতার পথে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজের প্রভাবশালীরা অসহায় হয়ে পড়েছে। বুদ্ধিজীবীরা মুখে লাগাম পরে নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে কোনোমতে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সুযোগে জোর যার মুল্লুক তার সূত্র প্রয়োগ করে দখল-চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, জুলুম-অত্যাচারের প্রতিকারহীন এক সাম্রাজ্য কায়েম হতে চলেছে।

    আমরা যারা কথায় কথায় এক-এগারোকে গালাগাল করেছি তাদের লক্ষ্য করে সেই সময়ের কুশীলবরা দাঁত বের করে হাসছেন। অন্যদিকে এক-এগারোর ফলে সৃষ্ট গর্তগুলো হাল আমলে এসে আরও বড় এবং বিস্তৃত হয়েছে। সেসব গর্তে অনৈক্য, অবিশ্বাস, অনাস্থার এত বিষবাষ্প জমা হয়েছে, যার কারণে গণতন্ত্র, রাজনীতি এবং সুশাসনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমতাবস্থায় বাঙালির সেই ভয় পাওয়া এবং ভয় দেখানোর প্রবৃত্তি বিপুল শক্তি নিয়ে দুই-এগারোর রাহুগ্রাস নিয়ে ভাবছে এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একদল হাসছে, অন্য দল কাঁপছে।

     

    গোলাম মাওলা রনি

    লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক