২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার, সকাল ৬:১১



আজ : ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার প্রকাশ করা : ডিসেম্বর ৬, ২০২৪

  • কোন মন্তব্য নেই

    গণঅভ্যুত্থানে সাহিত্যের ছাপ

     

    মুহাম্মদ কামাল হোসেন

     

    গণঅভ্যুত্থান একটি দেশের ইতিহাসে বিপুল পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে। যাপিত জীবনের প্রতিটি মোড়ে, যখন জনগণের অধিকার হরণ হয় এবং ক্ষমতাসীনদের শোষণ অব্যাহত থাকে, তখন সে সময় সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম হয়ে ওঠে। সাহিত্যে সে সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, যেখানে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য একত্রিত হয়, শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সাহিত্যের মাধ্যমে এ আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক কৌশল বা সমাজের অবস্থাই তুলে ধরে না, বরং জনগণের অবদমন, কষ্ট, ক্ষোভ, স্বপ্ন এবং আশারও প্রকাশ ঘটায়।

     

     

    বিশ্বের যে দেশেই গণঅভ্যুত্থান সংঘঠিত হয়েছে, সেখানকার মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিশাল অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জনগণের সাহসী প্রতিবাদ এবং অবিচারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সংগ্রামের গল্প তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন সর্বদাই বিশেষ স্থান দখল করে থাকে। এবং যখন এ আন্দোলন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন সাহিত্যের মাধ্যমে সে আন্দোলনের প্রতিধ্বনি আমরা অনুভব করি। আমাদের দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং তাদের সংগ্রামের ফলে সাহিত্যের শক্তি আরও গভীর হয়ে উঠেছে। বর্তমানের বিশ্বায়নের যুগে সাহিত্য প্রকাশের বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট মাধ্যমে এখন আর সাহিত্য আটকে নেই। এজন্যই এ গণঅভ্যুত্থান জাগানো সাহিত্যকে আটকানো যায়নি। আমরা স্কুলপড়ুয়া ছাত্রের মাকে লেখা চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পড়ে আপ্লুত হয়েছি। ভাইহারা বোনের অশ্রুভেজা লেখা ফেসবুকে পড়ে কেঁদেছি; এসবের সাহিত্য মূল্য এতটাই জোরালো ছিল যে, একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার মতো করে মানুষকে আলোড়িত করেছিল।

     

    আজকের জেন জি জেনারেশন সাহিত্যের বিবিধ ভাষা দারুণভাবে বুঝতে পারে এবং তাদের কাছে সাহিত্য কোনো একমাত্র প্রচলিত শৈলী বা ঐতিহ্যগত কাঠামো নয়; বরং এটি একটি নতুন চিন্তাভাবনা এবং নতুন অনুভূতির আধার। তারা সাহিত্যের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রা খোঁজেন এবং নিজেরা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা যোগ করে এর চলার পথকে সুগম করেন।

     

    বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোকে যদি আমরা ছাত্র আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করি, তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থান; এগুলো ছাত্র-জনতার সাহসী আন্দোলনের উদাহরণ। ছাত্ররা যখনই জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা শুধু একটি রাজনৈতিক দল বা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেনি, বরং একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষে নিজেদের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজও এ দেশের ছাত্র-জনতা সেই ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। যখন জনগণের অধিকার খর্ব হয়, যখন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী একের পর এক দুর্নীতি এবং অপশাসনের আশ্রয় নেয়, তখন সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম হয়ে ওঠে। সাহিত্য কখনোই নিছক কাব্য বা রোমাঞ্চের জন্য নয়; এটি সমাজের সংস্কৃতির, আধ্যাত্মিকতার এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি প্রামাণিক দলিল। সাহিত্য শুধু সরকারের অন্ধকার দিকগুলোকে উন্মোচনই করে না, বরং গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে জনগণের কষ্ট, তাদের সংগ্রাম এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন ঘটায়।

     

    বাঙালির সাহিত্য শুধু কোনো নির্দিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং সে জাতির মুক্তির জন্য যে কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে বারবার জেগে উঠেছে। আমরা যদি নজর দিই এ দেশের সাহিত্যের দিকে, আমরা যখন গণঅভ্যুত্থান এবং বিপ্লবের গল্পগুলো শুনি, তখন আমরা শুধু একটি আন্দোলনের ঘটনা শুনি না, আমরা শুনি সাধারণ মানুষের গর্জন, তাদের কষ্ট, বঞ্চনা ও হাহাকারের সংগ্রাম। সাম্প্রতিক সময়ের গণ-আন্দোলন, যে সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা আধুনিক সময়ের প্রতিবাদী সাহিত্যের এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। যা এখন আর বই বা পত্রিকায় ছাপায় সীমাবদ্ধ নেই। তাদের ভাষা স্লোগানে, তাদের কণ্ঠ সংগ্রামে, তাদের মনের অনুভূতিতে আজ এক দারুণ শিল্পনির্ভর বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। তারা লিখেন, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/বুক পেতেছি গুলি কর।’ তারা লিখেন ‘সাঈদ আবরার মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ’।…

     

    কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা নানা মাধ্যমে তাদের লেখালেখিতে এ আন্দোলনে সুর সঞ্চালন করেন। ধরনটা পালটেছে, কিন্তু সেই চিন্তানির্ভর সাহিত্যের আবেগই জনগণের ক্ষোভ, হতাশা, আশাকে জাগিয়ে তুলেছে। ১৯৯০ সালের আন্দোলনে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যখন ছাত্ররা একে একে ছাত্রাবাস এবং কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়েছিল। তাদের কণ্ঠে প্রতিবাদের ঝংকার ছিল, সাহিত্যনির্ভর স্লোগান ছিল, দ্রোহের কবিতা ছিল মুখে মুখে- যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

     

    গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা এবং এর ভাষা এখন গল্প কবিতা প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। গণঅভ্যুত্থানে সাহিত্যের ছাপ শুধু একটি জাতীয় চিত্র নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন যেন একটি জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, যা সাহিত্যের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে চলেছে। সাহিত্যের মাধ্যমে যে শক্তি, সাহস এবং বোধ সৃষ্টি হয়, তা একটি জাতির ইতিহাসে নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল রূপে প্রতিফলিত হয়।