মিল্কির ভেল্কি : শতকোটি টাকার দুর্নীতির পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে
নিজস্ব প্রতিবেদক । নিউজনেক্সটবিডি.কম
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) শ্রমিকলীগের সাবেক সভাপতি শামসুল আলম মিল্কি চাকুরি জীবনে এত প্রভাবশালী ছিলেন অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরও পেয়েছিলেন পদোন্নতি। অধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় এই মিল্কি ২০০৯ সালে বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে রাজউক অফিস ভাঙচুরের মত ঘটনারও জন্ম দিয়েছিল। প্রায় দুই দশক বছর ধরে রাজউকে দুর্নীতির সিন্ডিকেট করে প্লট জালিয়াতি, নথি গায়েব ও এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) নকলসহ নানা অভিযোগ অভিযুক্ত এবং অধিকাংশ প্রমানিত। কিন্তু কোনো ভাবেই মিল্কির প্রভাব বলয় ভেঙ্গে তাকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি রাজউক কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন।
কথিত আছে জাতীয় শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পোষ্ট পেতে কোটি টাকা খরচ করেছিলন মিল্কি, রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রভাব ব্যবহারের স্বার্থে। সফল হয়েছেন তিনি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) শ্রমিকলীগের সাবেক সভাপতি শামসুল আলম মিল্কি নির্দ্বিধায় অবসরে চলে গেছেন।
জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কয়েক দফা তলব করেছিল কিন্তু মিল্কির রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারেনি দুদক। নথীপত্র ঘেঁটে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজউকের উত্তরা, পূর্বাচল ও নিকুঞ্জের খালি প্লট বাছাই করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্লটের বরাদ্দপত্র, কিস্তি জমার ব্যাংক রশিদ হুবহু জাল তৈরি করে নিজের আপন ভাই-বোন-ভাতিজা-স্ত্রী-সন্তানদের বরাদ্দ গ্রহীতা সাজিয়ে সুকৌশলে লিজ দলিল করে নিজেরাই মালিক বনে যাচ্ছেন।
এভাবে মিল্কি ও তার আত্মীয়স্বজন পূর্বাচল প্রকল্পে ৮/১০টি এবং উত্তরা ৩য় প্রকল্পে ৫/৬টি প্লট হাতিয়ে নিয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে জাল জালিয়াতি করে পাওয়া মিল্কি ও তার আত্মীয়স্বজন পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন প্লট আবেদন করা অনেকেই। সাহেদ আলী নামের একজন বলেন, আবেদন করেও অনেক যোগ্য মানুষ প্লট পায়নি সেখানে প্রতারণা করে যারা প্লট পেয়েছে তদন্ত করে তা বাতিল করা হোক।
জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকা শহরের ডিআইটি প্রজেক্ট, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা এবং কেরানীগঞ্জে ২শ’র বেশি প্লট হাতিয়ে নেয়া আলোচিত গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে শামসুল আলম মিল্কির সম্পর্ক এখনো রাজউকের অভ্যন্তরীণ আলোচ্য বিষয়ের একটি।
এছাড়া উত্তরায় সাবেক এমপি হাবিব হাসানের সাথে মিলে ১১ নাম্বার সেক্টরের জমজম টাওয়ারের পশ্চিম দিকে রাজউকের জমিতে ফার্নিচার মার্কেট করেন মিল্কি, সেখান থেকে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা করে ভাড়া তুলতেন হাবিব হাসান ও মিল্কি।
বহু অভিযোগ ও বিভাগীয় মামলা মাথায় নিয়ে চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন। তবে রাজউকে ক্ষমতার দাপটে মিল্কি দ্বারা নানা ভাবে নিগৃহীত কর্মকর্তা কর্মচারীরা এখনও তাঁর অপকর্মের বিচার চান, এমনকি রাজউক কর্মকর্তা কর্মচারীরা মিল্কির রাজউক থেকে সকল অভিযোগের নিষ্পত্তি নিয়েও আপত্তি তুলছেন। যারা এসব তদন্ত করেছেন ও কমিটিতে ছিলেন তাদের মিল্কি টাকার বিনিময়ে কিনে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন।
সামসুল হক মিল্কি যে ভাবে রাজউকে :
রাজউকের জরিপসাথী পৈলন মিল্কির ছেলে এই সামসুল আলম মিল্কি । বাবার হাত ধরেই দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী হিসেবে রাজউকে যোগ দেন সামসুল আলম মিল্কি। চাকরি নিয়মিত হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তিনি ঊর্ধ্বতন হিসাব সহকারী হয়ে যান। রাজউক শ্রমিক-কর্মচারীদের নেতা আব্দুল জলিল, আব্দুল মালেক ও শফিউল্লাহ বাবু ওরফে সল্টুর সঙ্গে সখ্যতায় হয়ে ওঠেন জালিয়াত চক্রের হোতা।
ঢাকা শহরের ডিআইটি প্রজেক্ট, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে দুইশর বেশি প্লট হাতিয়ে নেওয়া বহুল আলোচিত গোল্ডেন মনিরকে এসব প্লট পেতে সহায়তা করছেন মিল্কি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ১৫ জন সিনিয়র কর্মচারীকে টপকে হিসাবরক্ষক হয়ে যান তিনি।
দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে বসতেন এস্টেট ও ভূমি-২-এর সহকারী পরিচালকের চেয়ারে। রাজউক অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন এই মিল্কি। এবং সর্বশেষ সহকারী পরিচালকের (চ. দা.) চেয়ারে বসেই পিআরএলে গেলেন রাজউকের দুর্নীতিবাজ শামসুল আলম মিল্কি।
রাজউক নথিতে মিল্কির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ :
মোস্তফা কামাল নামে এক ভুক্তভোগী রাজউকের চেয়ারম্যান বরাবর তার বায়না রেজিস্ট্রিকৃত প্লট আত্মসাতের অপচেষ্টার অভিযোগ করেন। রাজউকের উত্তরা জোনাল অফিসের অফিস সহকারী মো. সাইদুল হক ২০১৬ সালে অভিযোগ করেন ‘সামসুল আলম মিল্কি রাজউকের একজন অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। তিনি বিশাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
রাজউকের উত্তরা, পূর্বাচল ও নিকুঞ্জের খালি প্লট বাছাই করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্লটের বরাদ্দপত্র, কিস্তি জমার ব্যাংক রসিদ হুবহু জাল করে নিজের আপন ভাই-বোন-ভাতিজা-স্ত্রী-সন্তানদের বরাদ্দ গ্রহীতা সাজিয়ে সুকৌশলে লিজ দলিল করে নিজেরাই মালিক বনে গেছেন।
এই প্রক্রিয়ায় পূর্বাচল প্রকল্পে ৮টি ও উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ৫টি প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন। উত্তরায় ৭ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়কের ৬৭ নম্বর প্লটটি ভুয়া বরাদ্দপত্র তৈরি করে ভায়রা ভাইয়ের নামে আত্মসাৎ করেছেন। ৯ নম্বর সেক্টরে সাড়ে সাত কাঠা প্লটের ওপর ৯তলা আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন।’
মিল্কির সম্পত্তি:
২০০২ সালে রাজধানীর খিলক্ষেতে রাজউক ট্রেড সেন্টার নির্মাণ শুরু হলে তার কপাল খুলে যায়। কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রভাব খাটিয়ে অন্তত ২০টি দোকানের পজেশন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন মিল্কি। পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে একাধিক প্লট, নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় ১/ডি এবং ১৩ নম্বর রোডে ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে তার।
উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে রয়েছে ৯ তলা বাড়ি। বর্তমানে প্লটসহ বাড়ির মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। সোনারগাঁ জনপথ রোডে ৪ কাঠার প্লটে রয়েছে বহুতল ভবন। বনানীতে রোড নং-২৮, ব্লক-কে, হাউস নং ১৭/এ, এর ৫ কাঠার একটি প্লট জালিয়াতির মাধ্যমে বরাদ্দ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
বারিধারা জে ব্লকে তিনটি বাড়ি রয়েছে। সব মিলিয়ে শুধু রাজধানীতেই তার পাঁচশ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। ব্যবহার করেন তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি।
দুদকের মামলার বর্তমান অবস্থা :
মিল্কির বিরুদ্ধে জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্তের জন্য ২০১৬ সালের ১২ মে তাকে দুদকে তলব করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট তথ্য ও রেকর্ডপত্রসহ বক্তব্য গ্রহণের জন্য মিল্কিকে ডাকেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম সরকার। রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রভাবে সে তদন্ত আলোর মুখ দেখিনি। এ বিষয়ে মিল্কির সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি পরে হোয়াটসএ্যাপে যোগাযোগ করা হলে বলেন, রাজউকের সবগুলো অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে, দুদকের কিছু নিষ্পত্তি হয়েছে কিছু চলমান রয়েছে।